বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
কিশোর ফিকশন
।। নাবাসাতি।।
কে এম মিজানুর রহমান
বাবা ইমদাদুল হক ও মা মমতাজ বেগম জানেন না যে নাবাসাতি তাঁদের আসল মেয়ে নয়। ভিনগ্রহের মেয়ে। ভিন গ্রহ থেকে কিভাবে মমতাজ বেগমের কোলে এলো নাবাসাতি?
পদার্থ বিজ্ঞান বলে প্রত্যেকেরই একটা টুইন থাকে। কোথায় আছে সেই টুইন??
নাবাসাতি অদৃশ্য হতে পারে। কিভাবে শিখলো অদৃশ্য হওয়া???
ব্রেইনকে শক্তিশালি করতে দরকার কিছু কৌশল। কি সেই কৌশল???? এসব জানতে হলে বইটি পড়তেই হবে।
।। পর্ব এক।।
অনিকের ফর্সা ধবধবে মুখটায় কষ্টের ভাঁজ পড়েছে। এতো কষ্ট যে মুখটা কালো হয়ে গেছে। পেটের মধ্যে গুঢ় গুঢ় শব্দ হচ্ছে। প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। এক হাতে পেটটা চেপে ধরেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেড়াতে এসে এ সমস্যা হয়েছে। একটু আগেই সে গোটা তিনেক সিঙ্গারা খেয়েছিল প্রেসক্লাবের বিপরীতের ফুটপাথ থেকে। এখন পেটে মোচড় শুরু হয়েছে। মোচড় আর থামছে না। উদ্যানে ৪.০০টায় ওর এক বন্ধু আসার কথা, এখন বাজে ৩.৪৫। পেটে মোচড়ের জ্বালায় বন্ধুর কথা এখন আর মনে নেই। এখন দরকার একটা টয়লেট। টয়লেট খুঁজতে সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। কিন্তু কোথায় টয়লেট? কাউকে একথা জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করছে। হঠাৎ মনে পড়ল, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের কথা কিন্তু সেটাও এখন থেকে প্রায় দু’শ গজ দূরে, এ দু’শ গজই ওর কাছে দু’মাইলের মতো মনে হচ্ছে। এই বুঝি বেরিয়ে এলো, মনে মনে দোয়া পড়ছে। ‘হাগা এলো বাগা এলো লাল পেয়াদা খাড়া হলো’। দোয়াটা ওর নানা ভাই শিখিয়েছিল, এ দোয়া পড়লে চাপ কমে, কিন্তু চাপ কমলো না।
অনেক কষ্টে যখন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের টয়লেটের কাছে এলো, দেখে টয়লেটের দরজা তালাবন্ধ। শীট্ অনেক চেষ্টা করেও খোলা গেল না। মাথা কাজ করছে না আর। ডান পাশটায় চোখ পড়ে তার চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আরেকটা টয়লেটের দরজা একটু ভাঙ্গা। হাত দিতেই খুলে গেল, মনে হলো স্বর্গ, আঃ কি আরাম। এ মুহুর্তে সেল ফোনটা বেজে উঠলো। হ্যালো দোস্ত তুই কোথায়? আমি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে আরামের জায়গায় আছি। শালা, তুই আমাকে আসতে বলে কোন আরামের জায়গায়
আছিস জানতে পারি?
না রে দোস্ত তোকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসা সম্ভব নয়। কি বলছিস তুই! এমন কোন্ নরকে আছিস যে আমাকে নিয়ে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়?
নরক নয় দোস্ত স্বর্গ।
তুই থাক তোর স্বর্গ নিয়ে। আমাকে বিকেল ৪.০০টায় আসতে বলেছিলি এখন বাজে ৫.০০টা আর থাকা সম্ভব নয়। আমি চললাম। না না দোস্ত প্লি¬জ যাসনে, তোর সাথে ভিষণ জরুরী কথা আছে। তাহলে এইযে এক ঘন্টা দেরী করালি, কাজটা কি ভালো করছিস? ইমতি বললো। ভালো মন্দ বুঝি না, তবে এই দেরীর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। তুই আর একটু অপেক্ষা কর আমি এক্ষুণি আসছি। তোর সাথে শুধু জরুরী কথা নয়, অতি জরুরী কথা আছে। আসলে টয়লেটে ছিলাম। ওখানে কি তোকে নিয়ে যাওয়া যায়? ইমতি বললো-তা আগে বলবি তো?
এম- ৫ গ্রহে মরহুম নানা-নানীকে দেখা
তুইতো জানিস ইমতি শিশু বয়সেই আমি মাকে হারিয়েছি। এ পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপনজন ছিল আমার নানা-নানী। মা মারা যাবার পর নানীই আমাকে তার শিক্ষা ও আদর্শে লালন-পালন করেছেন। মায়ের অভাব এতটুকুও বুঝতে দেননি। নানীর দোয়াতেই আমি বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, সেই নানী বছর দু’য়েক আগে আমাকে ফাঁকি দিয়ে অন্য জগতে চলে গেলেন। নানী বলেছিলেন, আমি এমন জগতে চলে যাব যে তুই আর আমাকে খুঁজে পাবি না। কিন্তু আমিও নাছোর বান্দা। নানীকে বলেছিলাম তুমি যেখানেই থাক তোমাকে আমি খুঁজে বার করবোই।
সেই নানীকে সত্যিই খুঁজে পেয়েছি। শুধু নানীকেই নয়, মরহুম নানাভাইকেও সাথে দেখেছি। যিনি আরও আগে মারা গিয়েছিলেন। কি তাজ্জব লাগছে না। পৃথিবী থেকে মাত্র ১৩কোটি মাইল দূরে ‘এম-৫’ গ্রহে। কি বিশ্বাস হচ্ছে না তোর? ইমতির মনে হলো অনিক পাগল হয়ে গেছে। তবুও উৎসাহের সাথে বললো-তাজ্জব কি বাত! এ কি বলছিস তুই!! কি ভাবে খুঁজে পেলি নানীকে। সে অনেক কথা। পদার্থ বিজ্ঞান বলে এ বিশ্বব্রম্মান্ডে প্রত্যেকের মতো দেখতে আরেকজন মানুষের প্রতিরূপ আছে, মানে টুইন। সেটা দেখানোর জন্যই তোকে ডেকেছি।
ইমতি এ্যাস্ট্রোলজী পাস করে আমেরিকান এস্ট্রলোজিক্যাল সেন্টারে ইন্টার্ণী করছে। দু’মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে এসে দু’বন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
বেড়াতে এসেছে। অনিক তার ল্যাপটপটা ওপেন করলো। একটা গ্রহের ছবি। পকেট থেকে ছোট একটা বিভিন্ন রঙে রং করা ধাতব টেলিস্কোপের মতো দেখতে কি একটা গোলাকার যন্ত্র বের করলো। ভেতরে একটা ফুটো। সাথে একটা লেন্স, তাতে স্কেল বসানো। গোলকটা ইমতির হাতে দিয়ে বললো, গোলকটার দক্ষিণ দিকের অক্ষ বরাবর পৃথিবী থেকে ৪৫০ এঙ্গেলে চোখ রাখ। তবে স্বাভাবিক চোখে কিছু দেখতে পাবি না, ৩ডি ছবি দেখার মতো করে
তাকাতে হবে, ওকে! বলে ইমতি মানে ইমতিয়াজ টেলিস্কোপটা চোখে লাগালো। অবাক হলো ইমতি। তোর নানীর মতোইতো লাগছে। এক ছোকড়া ছেলের সাথে গল্প করছে। টেলিস্কোপের নব্ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব ভালো করে দেখলো। ¯পষ্টই দেখা যাচ্ছে ওর নানীকে। নানীকে ও শেষ দেখেছিল বছর পাঁচেক আগে। নানীর চেহারা একটুও বদলায়নি। ইমতি আমাকে জিজ্ঞেস করলো অনিক পাশে ওই ছোকড়া মতো কাকে যেন দেখতে পাচ্ছি! চুটিয়ে গল্প করছে। আমি ইমতির হাত থেকে টেলিস্কোপটা নিয়ে গোলকটার দিক বরাবর একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে চোখ রাখলাম। নানাভাইয়ের মতো লাগছে দেখতে। নব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালো করে দেখে নিশ্চিত হলাম সত্যিই নানাভাই। অবাক হলাম তাঁকে দেখে। নানাভাই এক্কেবারে যুবক হয়ে গেছে। তাঁর যুবক বয়সের ছবি এখনও আমাদের ঘরে টাঙানো আছে। হুবহু সেই চেহারা। মিলে যাচ্ছে নানাভাইয়ের সাথে। নানা এবং নানী একত্রই বা হলো কি করে? ইমতিকে বললাম নানাভাইয়ের চেহারার রহস্যময় পরিবর্তন আমাকে বিস্মিত করছে। আমি অবাক হচ্ছি এ কি করে সম্ভব! এর রহস্য আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। পার্ক থেকে ইমতিকে বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরলাম।
অনিক কি আমাকে চিট করলো? ও কি মাইক্রো ক্যামেরায় পূর্বে ধারনকৃত নানা-নানীর ভিডিও ক্লিপ সূক্ষ কারচুপির মাধ্যমে সেট করে আমাকে ভেল্কি দেখালো? আমাকে কি অবাক করা তার উদ্দেশ্য ছিল? এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পৃথিবীতে যে মানুষ মারা গেছে, অন্য গ্রহে তাকে দেখা যাবে। তাও কিনা আবার কম বয়সী। যা দেখলাম তা বাস্তবের মতোই লাগছে, কোন ভুল চোখে পড়ছে না।
আমি রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৪/১ আর কে মিশন রোডে চার তলার বাসায় থাকি। বাসাটা পুরাতন হলেও অনেক চমৎকার। বেশ বড় বাসা। বাড়ীর মালিক গ্রাম্য ঢংয়ে তৈরী করিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে থাকার জন্য। দক্ষিণের জানালার পাশে বেশ বড় একটা উঠোন। উঠোনের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণ থেকে একটা খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে। উঠোনের পূর্ব এবং উত্তর পাশটায় আমি নিজ হাতে দেশী বিদেশী কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছি টবে। সব আমার পছন্দ মত। আমি যত ক্লান্ত বা কষ্টেই থাকি না কেন এ উঠোন-বাগানে মাদুর পেতে আকশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সব ক্লান্তি-কষ্ট দূর হয়ে যায়। অনাবিল আনন্দে ভরে যায় মন। পশ্চিম পাশে একটা ঘর। ঘরের উত্তর পাশে লাগোয়া রুমটা ড্রইং রুম সাথে মিনি লাইব্রেরী। আমি রাতের বেশির ভাগ সময় এ রুমেই কাটাই। আজ শুয়ে শুয়ে জুলভার্নের ‘দি মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ বইটি পড়ছিলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি, হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মনোযোগ ভাঙ্গল। কড়া নাড়ার শব্দটা অদ্ভুদ। ৩০ সেকেন্ড নীরব থাকার পর আবারও শব্দটা শুনলাম। ফ্যাস ফ্যাসে গলায় কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। আবার কড়া নাড়ার শব্দ হলো। রাত তখন ১.০০টার মতো হবে। বাসায় আমি একা।
খুব ভয় ভয় লাগছে। এত রাতে কড়া নাড়ার মতো কেউ বাসায় নেই। নীচে কলাপসিবল গেটে তালা দেয়া। বাসায় ঢুকবার সদর দরজায় আরও একটা তালা, তারপর আরো দু’দুটো গেট পার হয়ে তবে বাসায় ঢুকতে হয়। সব গেটেই স্টিলের বড় বড় তালা লাগানো। বাইরে থেকে কোন লোক বা প্রাণী ঢুকে পড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। এখন মোবাইল যুগ চলছে, কেউ এলে অবশ্যই ফোন করে আসবে কিন্তু কারও আসবার কথাও নেই আজ। ৩০ সেকেন্ড পর তৃতীয়বার কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আমি আস্তে করে উঠে দরজাটা খুললাম। কেউ নেই। বাইরে মেঘ মুক্ত আকাশে ফুট ফুটে চাঁদ। মনে পড়লো আজ ৬ মে, ‘সুপার মুন’-এর আলো ঝরে পড়ছে পৃথিবীতে। দেখলে স্বর্গীয় একটা অনুভুতি জাগে মনে। এ রাতে চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে
গোল থালার মতো রুপোলি চাঁদ চক চক করছে। কোন বাতাস নেই। গ্রীষ্মের এ সময়টাতে সাধারণত বাতাসও থাকে না। ভয়ে ভয়ে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। সুপার মুন এর কারণে ভয় একটু কম লাগছে। উঠোন, ছাদ ঘুরেও কাউকে দেখতে পেলাম না। সব কিছু নিরব। একটা গাছের পাতা পড়লেও শব্দ হবে এমন অবস্থা। ভীতিকর একটা পরিবেশ। এতবড় বাড়ীতে আমি ছাড়া অন্য কেউ হলে ভয়ে এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে যেতো। আমি অজ্ঞান হইনি। আমার রুমে ফিরে এলাম। এসে দেখি আবাক করা কান্ড। আমার অগোছালো রুমটা কে যেন পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে। ঘরে প্লাস্টিকের ফলসহ এক গুচ্ছ আঙ্গুর লতা ঝুল ছিল। বেশ কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে ওয়ালের সাথে লেপটে ছিল। ওটাকে জোড়া দিয়ে ঘরের চার পাশে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মনে হচ্ছে জীবিত একটা আঙ্গুর লতায় থোকায় থোকায় সুন্দর সুন্দর আঙ্গুর ফল ঝুলে আছে। ঘরের সিলিং ফ্যানটা পরিষ্কার। ওয়ালম্যাট দিয়ে দেয়াল এমন সুন্দর করে সাজোনো হয়েছে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ঘরটা এখন খুব সুন্দর লাগছে। মুহুর্তে কে করলো এ কাজ? শত ভেবেও কূল কিনারা পেলাম না। আমি দরজা আটকে শুয়ে শুয়ে আবার বই পড়তে শুরু করলাম। বই আর মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারছি না। আমি স্পষ্ট আমার রুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটির শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ, মিনিট পাঁচেক পর আমার ঘাড়ের পাশে একবার নিশ্বাসের শব্দ পেলাম। নিশ্বাস না বলে দীর্ঘশ্বাসও বলা যায়। ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদন্ড বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আমার শরীরের প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে গেছে। বার বার মনে হচ্ছে আমি কেন সবার সাথে বেড়াতে গেলাম না। ছোট বেলার একটা স্মৃতি মনে পড়ায় ভয় আরও
বেড়ে গেল।
।। নাবাসাতি।। পর্ব দুই পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চলবে-
0 coment rios: