লিখেছেন সারফুদ্দিন আহমেদ
‘ওরে বুজি, শুনিছিস কি আচানক ঘটনা! এই বুড়ো বয়েসে জেনিফারের বাপ-মার নাকি ছাড়াছাড়ি অইয়ে গেইছে!’
বিল গেটস আর মেলিন্ডা গেটসের বাড়ি যদি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী বা টুঙ্গিপাড়ায় হতো, তাহলে নির্ঘাত সেখানকার কোনো না কোনো মুরব্বি স্থানীয় ‘লোকাল বিবিসি’ ওপরের কোটেশনে আটকানো ভাষায় খবরটা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সারা গ্রামে রাষ্ট্র করে দিতেন।
তারপর বিল কোন বংশের লোক এবং মেলিন্ডা কোন বাড়ির মেয়ে, তাই নিয়ে হাবিলের বাপের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কাবিলের মায়ের বরইতলায় ব্যাপক ‘গুজুর গুজুর-ফুসুর ফুসুর’ চলত।
এর কারণ, ২৭ বছর সংসার করে তিন ছেলেমেয়ের বাবা-মা হওয়ার পর কোনো সচ্ছল, শিক্ষিত ও পরিণত বয়সের দম্পতির ডিভোর্সকে বাঙালি মানস কোনোকালেই সহজভাবে নিতে পারেনি। আজও পারে না। আর তা পারে না বলেই এ ধরনের ছাড়াছাড়ির মতো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়েও বাঙালির কৌতূহল বিরাট।
এই ছাড়াছাড়ির সঙ্গে ১৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সম্পত্তি ভাগাভাগি এবং তার জেরে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষের স্বার্থের ইস্যু জড়িয়ে আছে। এটিই এই বিচ্ছেদবিষয়ক চর্চার বড় কারণ। গেটস পরিবারের এই ছাড়াছাড়ি কিছুদিন আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পাওয়া ‘বেলা শেষে’ ছবির পটভূমিকে আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছে। শিবপ্রসাদ মুখার্জি ও নন্দিতা রায় পরিচালিত ছবিতে মিস্টার মজুমদার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বিয়ের ৪৯ বছর পার করে এসে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) সংসার করবেন না। তিনি ডিভোর্স চান। এ নিয়ে দুজন আদালত পর্যন্ত যান। এত বছর সংসার করার পর তিনি কেন ডিভোর্স চাইছেন, সেই কৌতূহলই দর্শককে গল্পের পরিণতি দেখার আশায় টেনে রেখেছে। এই ছবিতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত মজুমদার দম্পতির বিচ্ছেদ হয় না। হয়তো এ কারণেই এই ছবির আনন্দসূচক পরিণতি হিসেবে মজুমদার দম্পতিকে পৃথক করা হয়নি। কিন্তু বিচ্ছেদ কি সব সময়ই বেদনার? পশ্চিমা সমাজে হয়তো সর্বাংশে তা নয়। কারণ প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্যে এসে অনেক দম্পতি সেখানে বিচ্ছেদ চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। দুই-তিন দশক পরস্পরের সান্নিধ্যে কাটিয়েও সম্পর্ককে তাঁরা আর বহন করতে পারছেন না। বিচ্ছেদ তাঁদের কাছে নিষ্কৃতি। ফলে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা বদলে যাচ্ছে। এ কারণেই হয়তো ‘বেলা শেষে’র মিস্টার মজুমদার ছেলেমেয়েদের সামনে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত জানালে তাঁর স্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এত দিনে মুক্তি।’ এটি হয়তো এ দেশেরও বহু পুরুষের পাশাপাশি বহু নারীরও মনের কথা। অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আড়ালে রয়েছে একাকিত্বের আবরণ। কখনো বা নিহিত সত্য আরও করুণ। অবমাননা, উদাসীনতা অগণিত দাম্পত্যকে অসহনীয় করেছে। তাই হয়তো আরোপিত সম্পর্ক নিষ্প্রাণ কর্তব্যের ভার বহন করে প্রৌঢ়ত্বে এসে সার্থকতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। জীবন মহার্ঘ-দিন ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে এই বোধ তীব্র হতে থাকে।
সূত্রঃ প্রথম আলো
0 coment rios: