লেখা:আলমগীর আলম
আমাদের সমাজে এখন প্রধান একটি ব্যাধি হলো শরীরজুড়ে ব্যথা। কারও কোমরে ব্যথা তো কারও হাঁটু কিংবা ঘাড়ে; কারও গোঁড়ালিতে তো কারও পিঠে। ব্যথা নানা পেশিতে, হাড়ে বা জয়েন্টে। তার সঙ্গে কমন একটি ব্যথা হচ্ছে মাথাব্যথা। ব্যথা কমানোর জন্য ভূরি ভূরি ব্যথানিরোধক ওষুধ বা পেইনকিলার আমরা খেয়ে থাকি। এর সঙ্গে আছে নানা ধরনের প্রলেপ দেওয়ার নামে মলম–জাতীয় ওষুধ। যতক্ষণ ওষুধের ক্রিয়া আছে, ততক্ষণ ভালো আর ক্রিয়া শেষ হলেই ব্যথা আবার ফিরে আসে। মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ে আর ব্যথা বাড়তে থাকে, নানা ধরনের এক্সাসাইজেও চেষ্টার কমতি থাকে না। কিন্তু ব্যথা থেকেই যায়।
ব্যথার জন্য প্রচলিত চিকিৎসা ছাড়াও বিকল্প চিকিৎসা আকুপ্রেশার দিয়ে ব্যথা কমানো যায়। এর ভালো দিক হচ্ছে, নিজে নিজেই ব্যথা কমানোর জন্য আকুপ্রেশার করা যায়। শুধু হাত দিয়ে নিজেই আকুপ্রেশার করে অনেক জটিল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব!
কোমরে ব্যথার নানা কারণ
আমরা সাধারণত দেখে থাকি, মেরুদণ্ডের মাংসপেশি, লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিঁড়ে যাওয়া, মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী ডিস্ক সমস্যা, ডিস্কের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে কোমরে ব্যথা হয়ে থাকে। চলাফেরা, খুব বেশি ভারী ওজন তোলা, মেরুদণ্ডের অতিরিক্ত নড়াচড়া, টানা বসে বা দাঁড়িয়ে কোনো কাজ করা, কম্পিউটার ও মোবাইল অধিক হারে ব্যবহার, মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়া, সর্বোপরি কোমরের অবস্থানগত ভুলের জন্য ব্যথা হয়।
অন্যান্য কারণের মধ্যে বয়সজনিত মেরুদণ্ডের ক্ষয় বা বৃদ্ধি, অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা গেঁটেবাত, অস্টিওপোরেসিস বা হাড়ক্ষয়, এনকাইলজিং স্পনডাইলাইটিস, মেরুদণ্ডের স্নায়ুর সমস্যা, টিউমার, ক্যানসার, বোন টিবি, কোমরের মাংসে সমস্যা, বিভিন্ন ভিসেরার রোগ বা ইনফেকশন, বিভিন্ন স্ত্রীরোগজনিত সমস্যা, মেরুদণ্ডের রক্তবাহী নালির সমস্যা, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি।
মুক্তিদিতে পারে আকুপ্রেসার
আকুপ্রেশার হচ্ছে শরীরে অভ্যন্তরে প্রবাহমান জৈববিদ্যুৎ দ্বারা চালিত একটি চিকিৎসাপদ্ধতি, যা নিজেই নিজের চিকিৎসা করতে পারবেন। শুধু নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে চাপ দিলেই ঠিক নির্দিষ্ট স্থানের ব্যথা কমে আসে। এখনো এটা নিয়ে বিস্তর নিরীক্ষা হয়নি, তবে নানা উপায়ে স্বীকার করা হচ্ছে, আকুপ্রেশার কার্যকর একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। বিশেষ করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত পেইন ম্যানেজমেন্ট থেরাপি। উন্নত বিশ্বে এখন বিভিন্ন থেরাপি সেন্টারে আকুপ্রেশার স্থান করে নিয়েছে।
যেভাবে আকুপ্রেশার শুরু করবেন
আপনার শরীরে যে ব্যথাই থাকুক, দুই হাতের তালুতে দুই মিনিট ঘষতে হবে, যাতে হাতের তালু দুটি গরম হয়ে যায়, তারপর গরম হাত দুটি এক হাত অন্য হাতে চাপ দিতে হবে, এতে সময় নেবেন তিন মিনিট। এবার কোমরের ব্যথার জন্য ইনডেক্স ফিঙ্গার বা তর্জনির উপরিভাগে কবজি থেকে নখ পর্যন্ত আস্তে আস্তে করে চাপ দিতে হবে। বিশেষ করে বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনি যেখানটায় মিলেছে, সেখানে চাপ দিলে ব্যথা অনুভব হবে। ঠিক যেখানে ব্যথা অনুভূত হবে, সেখানে নিয়মিত এক শ চাপ দিতে হবে। একটি চাপের সঙ্গে আরেকটি চাপের মধ্যে দুই সেকেন্ড বিরতি দিয়ে চাপ দিতে হবে। ঠিক ছবিতে দেওয়া চিহ্নে চাপ দিতে হবে। দুই হাতে একই নিয়মে আকুপ্রেশার করতে হবে। সারা দিনে দুইবার খালি পেটে নিয়মিত আকুপ্রেশার করলে কোমরের ব্যথা থেকে মুক্তি পাবেন।
যাঁদের হাঁটুতে ব্যথা আছে, তাঁরা কোমরের পয়েন্ট ছাড়াও কড়ে আঙুলের নখের সাইড থেকে কবজির হাড় পর্যন্ত সাইড দিয়ে বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ব্যথা পাওয়া যাবে, যা হাঁটুর পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়। বিশেষ করে কবজির উপরিভাগে এবং ঠিক কড়ে আঙুলের শুরু হয়েছে, এমন স্থানে চাপ দিলে কাঁধে ব্যথা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ঠিক এই সাইডে ওপর থেকে নিচে প্রতিটি স্থানে চাপ দিয়ে নামতে হবে, এভাবে এক শ বার করে দুই হাতে চাপ দিলে হাঁটু, হাতের কনুই ও কাঁধে ব্যথা কমে আসবে। এটাও দুই হাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে শোয়ার আগে নিয়মিত আকুপ্রেশার করতে হবে।
মনে রাখা প্রয়োজনযেহেতু আক্রান্ত হাতও আপনার, মুক্তির হাতও আপনার। তাই বলে সারা দিন হাত চাপা যাবে না। নিয়মিত ডোজের মতো করে সকালে খালি পেটে ও রাতে শোয়ার আগে উত্তম সময়। অফিসে যাওয়া ও আসার সময় গাড়িতে বসে আকুপ্রেশার করতে পারবেন। দিনে দুই বেলার বেশি নয় এবং সপ্তাহে ছয় দিন আকুপ্রেশার করুন। এক দিন বিরতি দিন। তাতে উপকার বেশি পাবেন। নিয়মিত আকুপ্রেশার করলে হাত ঝিনঝিন করা, অবশ হয়ে যাওয়া ও নিউরোজনিত সমস্যায় আকুপ্রেশার অনেক উপকারে আসে।
আদা-জল উত্তম পথ্য
ব্যথা কমাতে আদা-জল খেয়ে লাগার প্রয়োজন নেই। তবে প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যথা কমানোর জন্য আদা-জল হতে পারে উত্তম পথ্য। প্রতিদিন দুই বেলা খাওয়ার আধা ঘণ্টা পর এক কাপ পানিতে এক টেবিল চামচ আদার রস দিয়ে জ্বাল দিয়ে সেটা চায়ের মতো করে খেলে ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে হজমজনিত সমস্যারও উপশম হয়।
আধুনিক এই যুগেও কোমরব্যথা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাস্থ্যসমস্যা। এ সমস্যার সমাধানে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
লেখক: খাদ্য, পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ।
0 coment rios: