কিশোর
ফিকশন
।।রতন।।
কে এম মিজানুর রহমান
মানিক
ব্রাদার্স
ক্লাব-এর গলিতে রতনের
সাথে দেখা হয়ে গেলো।
মরা মানুষ জ্যান্ত দেখলে যে অবস্থা হয়
আমারও সেই অবস্থা। এই
দেখা হয়ে যাওয়া ছিল কল্পনাতিত, কারণ আমরা জানি
অনেক আগেই রতন মারা
গেছে, প্রায় এক যুগ আগে।
রতন
আমার বাল্যবন্ধু, সহপাঠি, শুধু স্কুল নয়,
কলেজেও একই হোস্টেলে থেকে
লেখা পড়া করেছি। ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর আলাদা হয়ে গিয়েছি। ও রাজশাহী ইউনিভার্সিটি আর আমি ঢাকা ইউনিভার্সিতে। আমরা
যে গ্রামে বাস করি সে
গ্রামটাও অদ্ভুত এবং সুন্দর, অদ্ভুত
বলছি এ কারণে যে
আর দশটা গ্রামের মতো
এ গ্রামটা নয়, অনেক বড়
এ গ্রাম। গ্রামটি পাড়ায় পাড়ায় বিভক্ত, বড়পাড়া, ছোটপাড়া, মধ্যপাড়া, পূবপাড়া, এরকম প্রায় ৩১টি পাড়া আছে।পূবপাড়াটা আবার ‘এল’ প্যাটার্নের, দক্ষিণ মাথা থেকে পূর্ব দিকে আরও সাত-আটটা বাড়ীর শেষ প্রান্তে রতনদের বাড়ী। অনেকে ভিটে পাড়া বলে। গ্রামের একদম উত্তরে বাজার, স্কুল, কলেজ সবই আছে এ গ্রামে।
ওদের বাড়ী থেকে বাজারটা উত্তর পশ্চিম কর্ণারে প্রায় এককিলো পথ। বাজারে যেতে মাঝা-মাঝি জায়গায় আরেকটু পূর্ব দিকে জোড়পুকুর। ঘটনাটা জোড়পুকুরকে ঘিরেই।
সিরাজগঞ্জ জেলার শেষ প্রান্তে চলনবিলের
একাংশের এ গ্রামটি বর্ষায়
ডুবে যায়, দূর থেকে
দেখলে মনে হয় কচুরী-পানার মতো ভাসছে। বর্ষাকালে
একবাড়ী থেকে আরেকবাড়ী যেতে
নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোন
উপায় নাই, বর্ষায় প্রতিটি
বাড়ীর ঘাটে নৌকা বাধা
থাকে। আশে পাশে দুতিন
মাইলের মধ্যে অন্য কোন গ্রাম
নাই। সন্ধ্যে বেলায় পাখীর কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে যায় প্রতিটি
বাড়ী। যে বাড়ীতে বড়
বড় গাছ আছে সেসব
গাছে বক, পানকৌড়ী, রাতচোরা,
হুতুম পেচা বাসা বাধে।
সে সময় গ্রামে কোন
কারেন্ট ছিল না, রাতের
আলোয় দূর থেকে দেখলে
ভুতুড়ে গ্রাম বলে মনে
হয়। কোন কোন বাড়ীতে
ভুতের উপদ্রব্যও আছে।
এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আমরা
ক’বন্ধু বিকেল বেলা নিয়মিত আমাদের
গ্রামের স্কুলের পিছনটায় বসে তাস খেলতাম।
প্রতিদিনই এখানে তাসের আড্ডা বসে, কেউ খেলে
কেউ খেলা দেখে। সবাই
নিয়মিত এখানে হাজির হতাম, রহিম, ফজল, মুকুল, মানিক,
রতন ও আমি। গত
দু’মাস ধরে নিয়মিত
উপস্থিতি ছিল এ আড্ডায়।
আজ রতন নাই, কোথাও
কেউ গেলে আগে থেকে
এখানে বলে যেতে হতো,
রতন কিছু বলে যায়
নাই, অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ওর
দেখা নাই। ওর সাথে
আমার ঘনিষ্ঠতা খুব বেশী, নির্দিষ্ট
সময়ে একে অপরের দেখা
না পেলে মনটা ব্যাকুল
হয়ে যেতো। আজও তাই হলো,
কোথাও গেলে আমাকেতো অন্তত
বলে যেতো, কিন্তু কিছু বলে নাই।
রতন গেল কোথায়?
পরদিন
সকাল হতেই ওর বাড়ীতে
গেলাম। আমাকে দেখেই ওর মা এগিয়ে
এসে জিজ্ঞেস করলো রতন কই?
বললাম আমিতো জানিনা! আমি ওর খোঁজেই
এসেছি, গতকাল বিকেলেও সে আমাদের কাছে
যায় নাই, বলতেই ওর
মা হাউ মাউ করে
কান্না শুরু করে দিলেন,
ওর বাবা ভিষণ চিন্তিত,
রতনের বৈশিষ্ট ও কাউকে না
বলে কোথাও যায় না বা
রাতে থাকে না, যদি
যায় বা থাকে সেটা
আমাদের বাড়ী, অন্য কোথাও না।
শুরু হলো খোঁজা খুঁজি,
আশে পাশে, দূর গ্রামে, শহরে
সমস্ত আত্মীয়-অনাত্মীয়ের বাসায় খোঁজ নেয়া হলো, কোথাও
নেই, কেউ কিছুই জানে
না। এক্কেবারে হাওয়া হয়ে গেলো! বড়ো
পাড়ার কালা রইসা শুধু
বললো, গতকাল সন্ধ্যেবেলায় জোড়পুকুরের পাড় দিয়ে হাঁটতে
দেখেছি। ওর কথায় ভয়ে
সবার মুখ শুকিয়ে গেল।
কারণ এই জোড় পুকুরে
মাঝে মাঝে ভয়ংকর কিছু
কান্ড ঘটে কিন্তু পুকুরের পানিতে বা চারপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রতনের দেখা পাওয়া গেল না।
গ্রামের
পূর্ব দিকে আধা কিলোমিটার দূরে এই জোড়পুকুর। ফাঁকা মাঠের মধ্যে এই জোড়পুকুর। একটু লম্বাটে নদীরমতো দেখতে পুকুরটা প্রায় ২০ বিঘার মতো হবে। রতনদের বাড়ী থেকে বাজারে আসার পথে পড়ে এ পুকুরটা। সবাই এ পুকুরটাকে এড়িয়ে চলে। এ পুকুরটা কবে কখন কে
তৈরী করেছিল এখনকার মানুষ কেউ বলতে পারে
না। একই রকমের এ
দু দুটো পুকুরের পাশা-পাশি অবস্থান মাঝে
মাঝে ধাঁধায় ফেলে দেয়। এ
পাশের পুকুরটার যে জায়গায় একটা
হিজল গাছ ও ঘাট
আছে ও পাশের পুকুরটারও
ঠিক ঐ জায়গায় আরেকটা
হিজল গাছ ও ঘাট
আছে, ঘাট অনেক পুরনো,
বেশীরভাগ জায়গাই ক্ষয় হয়ে গেছে।
এক পুকুরের প্রতিফলনে আরেক পুকুর তৈরী
হয়েছে। মনে হয় ডুপ্লিকেট। এমন
পরিকল্পিতভাবে যিনি পুকুরটা কেটেছে
তাঁর শিল্প জ্ঞান আছে। আমি আর
রতন অনেকদিন এ পুকুরঘাটে বসে
থেকেছি, পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছি। এবার মুল গল্পে
ফিরে যাই।
আজ দীর্ঘ একযুগ পর রতনকে দেখার
পর কেমন অচেনা অচেনা
লাগছে, রতনের দিকে চোখাচোখি হতেই
দু’জনের চোখ যেন
আটকে গেল, বেশ কিছুক্ষণ
তাকিয়ে রইলাম দু’জনে। বললাম
তুমি কি রতন? বলতেই
রতন, মানিক বলে আমায় জড়িয়ে
ধরলো, বেশ কিছুক্ষণ কেটে
গেলো এভাবে, এতোদিন কোথায় ছিল? জানার
জন্য মনটা ছটফট করছে।
ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম
আমার মতিঝিলের বাসায়। কেমন আনমনা
দেখাচ্ছে ওকে , অস্থির অস্থির ভাব, ওতো কখনও
এমন ছিল না। সব
সময় প্রাণবন্ত ও গল্পগুজবের জন্যই
আমরা অনেক রাত জেগে
কাটিয়ে দিয়েছি। ও ঘেমে গেছে,
এক গ্লাস লেবুর সরবত
বানিয়ে খাওয়ালাম। লুঙ্গি তোয়ালে দিয়ে বললাম আগে
গোসল করে ফ্রেস হয়ে
নাও, আমি ততক্ষণে খাওয়ার
ব্যবস্থা করি, রাতে জমিয়ে
গল্প করবো। গোসলখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য
ওর হাতটা টেনে ধরতেই
মনে হলো ওর গায়ে
কোন শক্তি নাই, ওজন নাই,
হাওয়ায় ভেসে আসছে আমার
সাথে। আমারতো ভয়ে দিশেহারা হবার
মতো অবস্থা। রতন বললো ভয়
পাসনে, তোকে আমি সব
বলবো কেন আমি ওজনহীন হয়ে পরি। পাঠক-পাঠিকা চলুন ওর নিজের
মুখেই শুনি ওর সাথে ঘটে
যাওয়া ঘটনাগুলো!!!-
সেদিন
ছিল ১৯৮২ সালের মার্চের
এক বিকেল। আমি দুপুর বেলায়
খেয়ে দেয়ে লম্বা এক
ঘুম দিলাম। উঠে জামা কাপড়
পড়ে তোমাদের কাছে আসবো কিন্তু
যেতে পারলাম না। নিশি পাওয়া
মানুষের মতো কেমন যেনো
ঘোরের মধ্যে হাঁটছিলাম! হাঁটতে হাঁটতে পথ ভুলে আমি
জোড়পুকুরের কাছে এসে পড়েছি।
এ ভয়ংকর পুকুর সম্বন্ধে আমরা কম বেশী
সবাই জানি। অনেক কিংবদন্তী আছে
এ জোড়পুকুর নিয়ে। অনেককেই তলিয়ে নিয়ে গেছে, পরে
আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ পুকুরে পানি খুব বেশী
নেই অথচ চৈত্র মাসে
যখন কোথাও পানি থাকে না,
তখনও এপুকুরের পানি একটুও কমে
না। অনেক সাহসিরাও দল
বেঁধে এসে গোসল করে
এখানে। পশ্চিম পাড়ের হিজল গাছের ডালে
নাকি এখনও লম্বা চুল
বিছিয়ে শুয়ে থাকে অশরীরী
কিছু। তালগাছের মতো লম্বা মানুষকেও
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে কেউ কেউ। গরু
ঝাঁপাতে (গরুকে গোসল করাতে) আসতো
অনেকে, অনেক গরু নাকি
এ পুকুরে তলিয়ে গেছে, ফলে এদিকটায় দিনের
বেলায়ও একা একা কেউ
আসতে চায় না। অথচ
কিভাবে যে আমি এখানে
এসে পড়লাম, আমার অবশ্য এসব
ভয় টয় তেমন নাই, তাতো তুমি জানো। কতদিন
এসব দেখার জন্য আমি আর
তুমি এখানে এসেছি, মনে পড়ে? কিন্তু
কোন দিনই কিছু দেখতে
পাইনি।
আমি
পুকুরের সিঁড়ির উপর এসে বসলাম।
তখন সবে সন্ধ্যা লাগছে, আগুনরঙা সূয্যি মামা পশ্চিমে ঢলে
পড়েছে। অর্ধেক তলিয়ে গেছে। মাঠের মধ্যে কোন লোকজন নেই,
সবাই ঘড়ে ফিরে গেছে।
এমন
নিঃসঙ্গ অবস্থায় প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছি। হঠাৎ একটা শব্দে
চমকে উঠলাম। আচমকা ঘাটের তৃতীয় সিঁড়ির উত্তর কোনার কয়েকটা ইট সড় সড়
করে সড়ে গেলো। তাকিয়ে
দেখি ওখান থেকে গাঢ়
কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, ধোঁয়াগুলো, ধোঁয়াগুলো আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটা কুন্ডলি পাকিয়ে সাপের মতো আমাকে পেচিয়ে
ফেললো। আমি হাত পা
কিছুই নড়াতে পারছি না। শরীর ওজনহীন
হয়ে গেলো, মাধ্যকর্ষণ শক্তি কোন কাজ করছে
না, একটু পর দেখি
আমি বাতাসে ভাসছি। ভয়ে আমার শরীরের
প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে
গেলো, কাঁপছি আমি।
ধীরে
ধীরে বেশ উপরে উঠে
গেলাম আমি। আসলে নিয়ে
যাওয়া হচ্ছে। হাওয়ার ওপর দিয়ে কোন
অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে টেনে নিয়ে
যাচ্ছে। ভাগ্যিস আশে পাশে কেউ
ছিল না। এ অবস্থায়
কেউ যদি আমাকে দেখে
ফেলতো তাহলে তার অবস্থা কেমন
হতো একবার ভাবতো পারো? টানতে টানতে আমাকে অন্য পুকুরের ঘাটের
সিঁড়ির ওপর বসাল সেই
অদৃশ্য শক্তি, আমি আমার
হারানো শক্তি আবার ফিরে পেলাম।
তবে ভয় যেটুকু ছিলো
সব তখন কেটে গেছে
হাওয়ায় ভাসতে বেশ ভালই লাগছিল।
আমি
যখন বসে বসে এই
ওড়ার কথা ভাবছিলাম ঠিক
সে মূহুর্তে একটা সুরেলা সঙ্গীত
বাতাসে ভেসে আসছিল। সঙ্গীতের
সূর ভিন দেশী। সঙ্গীতটা
কোন দেশের বলতে পারবো না
তবে খুবই ভালো লাগছিল
অচেনা এ সুরটি। সঙ্গীতের
মুর্ছনায় মনটা উদাস হয়ে
গেল। কতক্ষণ যে এ ভাবে
কেটেছিল বলতে পারবো না,
উদাস ভাবটা ভঙ্গ হলো তখন
যখন দেখলাম একটা বড় মাছ
লাফিয়ে উঠে আবার ঝপাৎ
করে পানিতে তলিয়ে গেল। পানির ঝাপটা
আমার শরীরের বেশ কিছু অংশ
ভিজিয়ে দিল, সঙ্গীতের সুর
তখনও বেজে চলছিল। হাতের
রেডিয়াম দেয়া ঘড়িতে তখন
দেখি রাত একটা বাজতে
পাঁচ মিনিটি বাঁকি, অথচ বাড়ী ফেরার
কথা একবারও মনে পড়ে নাই। রহস্য উদঘাটন করার আনন্দে বাড়ীর ভুলেই গেছি। সঙ্গীতের সুরটা কোন দিক থেকে
আসছিল বোঝা যাচ্ছিল না।
আমি বেশ খানিকটা পথ
এদিক সেদিক ঘুরলাম কিন্তু পেলাম না। অবশেষে আবার
ঐ সিঁড়িটায় বসতে যাব তখন
মনে পড়লো পুব পাশে
শুকনো একটা ছোট খাল
আছে, এগিয়ে গেলাম খুব সাবধানে, দেখলাম
অল্প একটু জায়গা আলোয়
আলোকিত হয়ে আছে, মনে
হচ্ছে আলোর বেড়া দেয়া
হয়েছে ঐ জায়গাটুকু। সামনে
রাখা গোল চাকতির মতো
একটা ধাতব কিছুর ওপরে
আঙ্গুল বুলিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত সুন্দরী এক মেয়ে। মসলিনের কাপড়ের ন্যায় একটা শাড়ী পড়ে
আছে, খুব কারুকাজ করা
শাড়ী। মুখটা আমার বিপরীত দিকে
ঘুরানো শুধু হাত দুটো
দেখতে পাচ্ছি স্বচ্ছ কাঁচের মতো নরম হাত
বুলিয়ে যাচ্ছে ধাতব পাত্রটায়, হঠাৎ
আমার গলার মধ্যে কি
একটা ছোট পোকা ঢুকে
গেল। না কেশে থাকতে
পারলাম না। কাশির শব্দে
মেয়েটা চমকে ফিরে তাকালো।
ভীষণ ভয় পেয়ে ধাতব
পাত্র নিয়ে পুকুর জলে
ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি অনেক্ষণ পুকুরের
মাঝে এদিক সেদিক খুঁজলাম
মেয়েটাকে। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলামনা। খুব খারাপ লাগছিল,
মেয়েটাকি ডুবে মারা গেল?
ইস আমার জন্যই জলে
ঝাঁপিয়ে মরলো মেয়েটা?
খালের
কাছে এগিয়ে গেলাম, বাল্বটা তখনও জ¦লছিল,
ছোট্ট মটর দানার মতো
বাল্ব। মাটি থেকে একটু
উপরে একটা মরা ডালের
সাথে আটকানো, দিনের আলোর মতো সব
কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, এরকম
বাল্ব কি করে বানানো
সম্ভব হলো? বাল্বটাকে হাতে
তুলে নিলাম। কোন ব্যাটারী বা
বৈদ্যুতিক সংযোগ নাই অথচ এতো
আলো! ভিষণ আনন্দ লাগছিল
বাল্বটা পেয়ে, নিশ্চয়ই হিরার চেয়েও অনেক বেশী দামি
হবে বাল্বটা।
নিজেকে
হিরো হিরো লাগছিল, আরে
আমি এখন আর রতন
নই, রাজাদের রাজা সম্রাটের সম্রাট হয়ে যাবো,
সাড়া দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে আমার নাম।
এ জিনিষ একমাত্র আমি ছাড়া আর
কারো কাছে নেই, আমি
অবাক বিস্ময়ে শুধুই দেখলিাম, দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। আনন্দের
আতিশয্যে নরম সবুজ ঘাসের
উপর কয়েকটা ডিগাবাজী খেয়ে নিলাম। আঃ
কি আনন্দ। কি মজা! এই
দূর্লভ জিনিষ শুধু আমার হাতে।
মেয়েটাতো মরেই গেছে এতোক্ষণ।
বেঁচে থাকলেও নিশ্চয়ই ও আমার কাছে আর
আসবে না। ঘড়িটার দিকে
চোখ চলে গেল। ৮.০০এএম মানে সকাল। আমরা
যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি বাল্বের আলোয়
শুধু সেটুকু দিনের মতো মনে হচ্ছে,
বাকী চতুর্দিকে ঘন অন্ধকার কিছু
দেখা যায় না। হাতের
বাল্বটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে মুঠো বন্ধ
করলাম, এবারে ঘন অন্ধকার ঘিরে
ধরলো, কোন কুয়াশা নেই।
রাতের তারাগুলো মিটি মিটি আলো
দিচ্ছে তখনো। এখানে এ ভুতুড়ে জায়গায়
আর থাকা নয়, বাড়ীর
কথা মনে পড়লো, টর্চ
লাইটের মতো বাল্বটা সামনে
বাড়ীয়ে ধরলাম, ভাবছি বাড়ী যাব, কিন্তু
কোন দিকে আমার বাড়ী
বুঝতে পারছি না, কিছুদূর এগিয়েছি
এমনি সময়ে পিছন থেকে
কে যেন আমার শার্ট
ধরে টান দিল, ভয়ে
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি
সেই মেয়েটি যাকে আমি ধাতব
যন্ত্র বাজাতে দেখেছিলাম। দেখলাম সুন্দর একটা মুখ আমার
দিকে তাকিয়ে হাসছে, ছোটবেলায় ‘ঠাকুমার ঝুলিতে’ ডাইনি বুড়ির অনেক গল্প পড়েছি।
ওরা সব কিছুর রূপ
ধরতে পারে। মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জন্তুতে পরিণত করে, তারপর খেয়ে
ফেলে, আমি কি সেই
ডাইনি বুড়ির খপ্পড়ে পড়লাম? তবে মেয়েটার চেহারা আর মিষ্টি হাসি
ডাইনির মতো নয়, একেবারে
সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের মতো, লম্বাটে চেহারা,
সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে ব্যাক্তিত্বের ছাপ,
বড় বড় চোখ নাকটা
সবচেয়ে বেশী সুন্দর। রুপোলি
জড়ীর মতো চুলগুলো চিক
চিক করছে, মনে হচ্ছে মৃদু
আলো ছড়াচ্ছে, গাঢ় বেগুণী শার্টের
সাথে ম্যাচ করা স্কার্ট একেবারে
খাঁটি বাঙালী পোশাক। পোশাক ছাড়া শরীরের বাঁকী
অংশে চোখ পড়তে আমার
মুখ থেকে রক্ত সড়ে
গেল, কাঁচের মতো স্বচ্ছ শরীর,
মনে হয় নাড়ী ভুড়ি
পর্যন্ত দেখা যাবে। আমি
আবার ভয় পাচ্ছি আমার
সমস্ত স্নায়ু টান টান
হয়ে গেল, কথা বলতে
ভুলে গেছি। থর থর করে
কাঁপছি আমি। হাত থেকে
ছিটকে পড়ে গেল বাল্বটা।
গড়াতে গড়াতে একটা কাঁকড়ার গর্তে
ঢুকে গেল বাল্বটা, সঙ্গে সঙ্গে
ভুতুরে কালো অন্ধকার নেমে
এলো চার পাশে। অন্ধকারে
আমার শরীরও দেখতে পাচ্ছি না। এই ভয়ংকর
অন্ধকার আমার মনে আরও
ভয় ধরিয়ে দিল। ভুত প্রেতেরা
যেন আমার চারপাশে নাচছে।
মেয়েটাকেও ও মুহূর্তে ডাইনি
বা ভুত ছাড়া আর
কিছুই ভাবতে পারছি না, এইতো এখন
আমাকে কোন জন্ততে পরিণত
করবে, তারপর একসময় খেয়ে ফেলবে। এই
আতংক জমানো ভয়ংকর অন্ধকার থেকে পালাতে পারলে
বাঁচি কিন্তু যাবো কোথায়? তার হাত তখনো
আমার শার্টের সাথে আটকে আছে,
মনে হলো এ হাত
আর কখনো ছাড়বে না,
সারা পৃথিবী এ সময় একেবারে
নিশঃব্দ। একটা শিয়াল কুকুর
ডেকে উঠলেও মনে হয় সাহস
পেতাম, সাহস পেতাম যদি
সামনে একটা বাঘও দেখতাম।
নীঃশব্দ যে এতো ভয়ংকর
হতে পারে প্রত্যক্ষ তা
বুঝলাম। আমার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক
তৎপরতা অত্যাধিক বেড়ে গেছে। ভয়ের
একটা ঠান্ডা স্রোত পা থেকে মগজে
খোঁচা দিচ্ছিল। সব কিছু ঝাঁপসা
দেখছি। এক সময় আমি
জ্ঞান হারালাম।
যখন
জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম সেই
মেয়েটি তখনও আমার পাশে
বসা। ষ্পষ্ট দিবালোক যখন আমি মেয়েটাকে
দেখছিলাম তখন ভয় অনেকটা
কেটে গেছে। আমি মেয়েটির দিকে
তাকিয়ে আছি। এখন আর
হাঁসের পা নেই, সেখানে
সুন্দর দুটি পা দেখা
যাচ্ছে। মনের মধ্যে কোটি
ভাবনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট
সূর্যের আলো আমার চারপাশে
অথচ সূর্য দেখা যাচ্ছে না।
আমার বাড়ী থেকে এ
জায়গার দূরত্ব খুব বেশী হবে
না। বড় জোর এক
মাইল অথচ বাড়ী দেখতে
পাচিছ না। এখন তো
দিন অথচ কোথাও
একটা লোকও দেখা যাচ্ছে
না। একবার মনে হলো দৌড়ে
পালাই কিন্তু পালাবো কোথায়? আমি যেন মায়াজালে
আটকা পড়েছি, এতে আর কোনই
সন্দেহ নাই। এ মূহূর্তে
মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সব কিছু
সাহসের সাথে মোকাবিলা করতে
হবে। সাহস হারালেই বিপদ
হবে। আমি নির্ভয়ে মেয়েটির
দিকে তাকালাম, বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েই
আছি। আচমকা মেয়েটি কথা বলে উঠলো।
ষ্পষ্ট বাংলা ভাষায় জিজ্ঞেস করলো অমন করে
তাকিয়ে কি দেখছো? মেয়েটির
কথায় কি যাদু অছে
জানি না, আমার সমস্ত
ভয় নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
মনে হলো আমি যেন
আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির পাশে বসে আছি।
এতোক্ষণ যে ভয়ংকর রক্ত
শিতল করা শিহরণ জাগানো
আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম সেই
ভয় এখন আর পাচ্ছি না।
স্বর্গীয় আনন্দে
মনটা ভরে উঠলো।
মেয়েটা
বললো, আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছো
কেনো? আমাকে দেখতে কি খুব ভয়ংকর
লাগছে? আমি কি তোমার
কোন ক্ষতি করেছি? শোনো আমাকে ভয়
পাবার কিচ্ছু নেই, আমি তোমাদেরই
মতো পৃথিবীর মানুষের পেটে জন্মেছি, তবে
আমার বাবা ভিন গ্রহের
বাসিন্দা, এ পৃথিবীর সাথে
আমাদের সুন্দর একটা সম্পর্ক আছে,
তা তোমাকে পরে বলবো, তোমাদের
পৃথিবীর মানুষের মতো আমরা কারো
কোনো ক্ষতি করি না। মানুষ
হয়ে জন্মে অন্য মানুষের ক্ষতি
করা ভিষণ পাপ কাজ।
তোমাদের পৃথিবীতে যুদ্ধের মতো ভয়ংকর ব্যাপার
স্যাপার আছে যা আমাদের
গ্রহে নাই। আমি থাকি
অন্য গ্রহে মাঝে মাঝে এখানে
বেড়াতে আসি। এ পুকুরের
তলায় আমাদের একটা বাড়ী আছে।
তোমাদের
মানুষের আচরণে বা স্বভাবে দু’টি স্বত্বা কাজ
করে ভাল স্বভাব এবং
মন্দ স্বভাব, মন্দ স্বভাব মানুষকে
পথভ্রষ্ট করে পাপাচারে লিপ্ত
করে। এ বিশাল ব্রম্মান্ডের
যে একজন মালিক আছে,
তাঁর কথা ভুলে যায়।
কিন্তু তিনি এমন কাজ
করে রেখেছেন যে তাঁর কাছে
একদিন ফিরে যেতেই হবে,
কারো সাধ্য নাই তাকে আটকে
রাখার, যতো বড়ো ক্ষমতা
ধরই হোক না কেনো।
মৃত্যু অনিবার্য তার পরেও সবকিছু
ভুলে মানুষ পাপাচারে লিপ্ত হয়, যুদ্ধে ভয়ংকর
সব অস্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, যা
আল্লাহর সৃষ্টিকেও ধ্বংস করে ফেলছে, এর
প্রতিশোধ কি সৃষ্টিকর্তা নেবে
না? এরা যদি ভাবতো
আমিও ধ্বংস হয়ে যাবো একদিন,
তাহলে কেউ পাপ কাজ
করতো না, আমাদের গ্রহে
কড়া বিধি নিষেধ আছে।
কেউ কারও ক্ষতি করতে
পারবে না, যদি করে
তাকে সাথে সাথে ধুলোয়
মিশিয়ে দেয়া হয়। কারও
কোন ক্ষতি না করে কিভাবে
গ্রহের মানুষদের উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়া যায়,
জীবন যাপন সহজ হয়
সে চিন্তা কাজ করে ।
এ কারণে তারা তাদের গ্রহের
এতো বেশী উন্নতি সাধন
করেছ, যা তোমারা পৃথিবীর
মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।
যেমন
ধরো তোমার মাথার উপরে অতি ক্ষুদ্র
একটা বাল্বকে মাধ্যকর্ষণ শক্তি হ্রাস করে শুন্যে ঝুলিয়ে
দিয়েছি, সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আলোকিত
করেছি, তাতেই দিনের আলোর চেয়েও স্পষ্ট
মনে হচ্ছে নয় কী? যখন
বুঝলাম তোমরা দিনের আলোয় ভয় পাও
না তখনই আমি এই
ব্যবস্থা করেছি অথচ আমরা কিন্তু
আলো এবং অন্ধকার দুটোকেই
বেশী গুরুত্ব দিই। রাত দিনের
পরিশ্রমই আমাদের গ্রহের বাসিন্দাদেরকে বিজ্ঞান সাধানয় অনেক দূর এগিয়ে
নিয়ে গেছে। যদি তুমি জানতে
চাও তবে সবই তোমাকে
দেখাবো তবে ভয় পাওয়া
চলবে না।
আমি
এতোক্ষণে মেয়েটির দিকে তাকালাম। ওর
গভীর ঘন কালো চোখের
দিকে তাকিয়ে আমি যেন সম্মতিহ
হয়ে পরলাম। কথা বলার শক্তি
হারিয়ে ফেলেছি। মেয়েটিই বলে উঠলো-
আমি
তোমার মনের কথা সব
বুঝতে পারছি, টেলিপ্যাথি বলে একটা কথা
আছে না, মাঝে মাঝে
তা আমার মধ্যে এমনিতেই
কাজ করে। তুমি জানতে
চাচ্ছো আমি কে কোথা
থেকে এলাম, কি আমার পরিচয়?
সূর্যের আলোকে কিভাবে কাজে লাগিয়ে বাল্বকে জ্বালিয়ে শূন্যে
ভাসিয়ে রেখেছি, এটাকে অন্য কাজে লাগানো
যায় কি না? কিভাবে
খাদ্যকে এটোম বোমার মতো
শক্তিশালি খাদ্যে রূপান্তরিত করা যায়?
আমি
ওর কথা শুনে অবাক?
মেয়েটি আমার মনের কতা
ধরে ফেলেছে, বললাম তাই, তুমিকি আমাকে
শিখিয়ে দেবে এগেুলো? আমাদের
দেশের বেশীর ভাগ মানুষই খুব
গরীব অনেকেই আছে না খেয়ে
দিন পার করতে হয়।
তুমিকি সত্যিই আমাকে শিখিয়ে দেবে এগুলো? অবশ্যই
বলে মেয়েটি আমাকে অবাক কর দিয়ে
পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো, একটু বললোও না
যে তুমি একটু অপেক্ষ
করে আমি আসছি।
মিনিট
পাঁচেক পরেই ফিরে এলো
মেয়েটি। তাতে দুটো পুটলি।
আশ্চর্যের বিষয় মেয়েটির শরীরের
কোথাও এক ফোটা পানির
চিহ্ন মাত্র নেই! এটা কি
করে সম্ভব! আমার মাথার মধ্যে
সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে,
আমার কি মস্তিষ্ক বিকৃতি
ঘটছে। কিন্তু এমনেতো হবার কথা নয়।
নাকি স্বপ্ন দেখছি। গায়ে চিমটি কেটে
দেখলাম ব্যাথা লাগে এতএব স্বপ্নও
নয়, মনে মনে ভাবছি
আমি এর শেষ না
দেখে আর বাড়ী ফিরছি
না। আবার ভাবছি আমি
পৃথিবীর আলো বাতাসের মধ্যেই
আছি নাকি অন্য কোন
গ্রহে আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে।
অবশ্য্ অন্য কোন গ্রহে
এলে টের পেতাম এটুকু
বাহ্য জ্ঞান এখনো আমার আছে।
তা ছাড়া দিব্য চোখে
দেখতে পাচ্ছি এই আমাদের মাঠ
এই জমজ পুকুর পুকুরের
ঐ কিনারে হিজল গাছ। সব
দেখতে পাচ্ছি শুধু দেখতে পাচ্ছি
না দুরের গ্রামগুলো অমাদের বাড়ীটা যা দেখতে পাওয়া
উচিৎ ছিল, কারণ আমাদের
বাড়ীটা এখান থেকে খুব
বেশী দূরে নয়। এবং
মাঠের পরেই গ্রামের শুরুতে।
আমি যখন এসব ভাবছি
তখন মেয়েটি এসে আমার একটা
হাত ধরে বললো এসো
আমার সঙ্গে, আমি হাঁটছি ওর
হাতের মুঠোর মধ্যে আমার হাত। আনন্দের
একটা শিহরণ বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে
পড়েছে আমার শরীরে, পৃথিবীতে
এতো আনন্দ আছে আমি জীবনে
কখনো কল্পনাও করতে পারিন। আমার
শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে আনন্দের
হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে কলমের ভাষায়
এর প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
শুধু অনুভব করতে পারছি। আহ
কি সুখ! এই সুখের
জন্যই মানুষ কত কি করে
বেড়োয় আর সেই সুখ
এখন আমার হাতের মুঠোর
মধ্যে। অথচ কিছুক্ষণ আগেও
যাকে দেখে আমি ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম কোন
অশুভ আশংকায়।
মেয়েটি
একটা জমির কাছে এসে
থামলো। জমিটি চাষ করা। মেয়েটি দ্রুত একটা পোটলা
খুলে ফেললো। পোটলার মধ্যে কালো মতো কিসের
পাউডার, সেগুলো জমির মধ্যে ছড়িয়ে
দিয়ে অন্য পোটলাটাও খুলে
ফেললো, ছোট ছোট ধানের
বীজ বেরিয়ে এলো তার মধ্যে
থেকে তার পর সেই
বীজ গুলো ছড়িয়ে দিলো
মাঠের মধ্যে? চমক কাকে বলে!
ধানগুলো নড়া চড়া করছে,
আমার দুই চোখ বিস্ফারিত।
আমি চেয়ে আছি ছড়িয়ে
দেয়া সেই ধানবীজগুলোর দিকে।
মুহুর্তে অংকুরিত হয়ে গেল সেই
বীজগুলো, বড় জোর মিনিট
দুই কেটেছে, সবুজ চারায় ছেয়ে
গেল যতটুকু মঠের মধ্যে সেই
কালো পাউডার ও ধানের বীজ
ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সময়
গড়াচ্ছে আমার চোখের সামনে
সেই চারাগুলে বড় হতে লাগলো।
ধীরে ধীরে। আমি যেন টিভি
পর্দায় কোন এনিমেশন দেখছি।
এক সময় চারাগুলো বড়
হলো। বেশ মোটা মোটা
থোড়, তারপর সেই থোর থেকে
বেড়িয়ে এলো থোকা থোকা
ফুল ধান, আমি রুদ্ধশ্বাসে দেখছি, দেখছি
আর ভাবছি। সেই ধান পুষ্ট
হলো এবং এক সময়
সোনালী পাকা ধানে ভরে
গেল মাঠ, পাশে একটা
যন্ত্র রাখা ছিল দেখতে
পাইনি যন্ত্রটি দিয়ে সেই ধান
কেটে আটি বাঁধা হলো।
কি মিষ্টার! খুব আবাক লাগছে?
এই এক সমস্যা এই
সামান্য জিনিষ দেখেই খুব অবাক হয়ে
গেলে? আমি ভাবছি ওর
কাছে এটা খুব সামান্য
ব্যাপার তাহলে এর চেয়েও অসামান্য
কিছু আছে নাকি?
ওর এই সামান্য ব্যাপারটাই
যদি আমি জেনে নিয়ে
আমার দেশে প্রয়োগ করতে
পারি তাহলে আমাদের দেশের মানুষ কেউই না খেয়ে
থাকবে না। শুধু ফসল
উৎপাদন করেই দেশের অর্থনীতি
পাল্টে ফেলবো, পত্রপত্রিকায় বড় বড় হরফে
লেখা হবে আমার আবিষ্কারের
কাহিনী, রেডিও টিভিতে প্রচার হবে আমার নাম।
হিরো হয়ে যাবো মুহূর্তে।
সবচেয়ে বড় কথা এ
হত দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের মানুষকে ভুখা থাকার হাত
থেকে বাঁচাতে পারবো। আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থণা
করছি এটা জেনে নেয়া
এবং বাড়ীতে ফিরে এর বাস্তব
প্রয়োগ করার সময় পর্যন্ত
আমাকে বাঁচিয়ে রেখো।
সেই
সন্ধ্যায় বাড়ী থেকে বের
হয়ে মেয়েটার সান্নিধ্যে আসা অবধি কতটুকু
সময় যে কেটে গেছে
বলতে পারবো না, সময়ের সাথে
তাল মিলিয়ে ঘড়িটা যে চলতে পারছে
না তাও বুঝতে পারছি
অথচ এ কোয়ার্টজ ঘড়িটায়
সময় হের ফের হওয়ার
কোনই সম্ভাবনা নেই। রাত দিন
কোন দিক দিয়ে কেটে
যাচ্ছে বুঝতে পারছি না, এতগুলো সময়
পার হয়ে গেল
ওর সান্নিধ্যে অথচ মেয়েটাকে জানা
হলোনা সেই দেখা হওয়ার
পর থেকেই মেয়েটা একটা না একটা
কান্ড ঘটিয়েই যাচ্ছে? জানার সুযোগটুকুও দিচ্ছে না, নাকি ইচ্ছে
করেই যে নিজের পরিচয়টা
লুকিয়ে রাখছে। ওর নাম ঠিকানা
জিজ্ঞেস করবো ঠিক সে
মুহুর্তেই দূরে ছায়ার মতো
একটা মানুষের অবয়ব চোখে পড়লো।
অবয়বটা মানুষের মতো হলেও সেযে
পৃথিবীর কোন প্রাণী নয়
বেশ বুঝতে পালাম। চকিতে মেয়েটার দিকে ফিরে তাকালাম,
ভয়ে তার সাদা মুখ
আরও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে অথচ
আমি জানতাম তাদের ভয় বলতে কিছু
নেই। এক মুহুর্ত দেরী
না করে মেয়েটা তার
বা হাত আমার বগলের
তলা দিয়ে জাপটে ধরে
শুন্যে লাফিয়ে উঠলো। চঞ্চলা ভিতু হরিণির মতো
এদিক ওদিক একবার তাকালো।
দ্রুত উড়ে গেল
বাল্বটার কাছে। বাল্বটা ছাড়িয়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেললো
কাপড়ের তলায়। অমাবশ্যার গাঢ় অন্ধকার নেমে
এলো, নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি না। আমি অনুভব
করছি আমার শরীরের ওজন
বলতে আর কিছু নেই।
হালকা তুলোর মতো উড়ে চলছি।
ওর নরম শরীর আমার
শরীরের সাথে মিশে যাচ্ছে।
এক সময় মেয়েটা আমাকে
একটা ট্যাবলেট খেতে দিল। আমি
নির্দ্বিধায় সেটা খেয়ে ফেললাম।
এ সময়ে যদি আমি
কোলের ওপর মরেও যাই
তাহলে আমার অতৃপ্তির আর
কিছুই থাকবে না।
ট্যাবলেট
খাওয়ার সাথে সাথেই দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে
গেল। কোন শক্তির বলে
যে উড়ে চলেছি জানি
না। উড়ার গতি ক্রমেই
বাড়ছে। আমার মনে হলো
পৃথিবীর মাধ্যকষর্ণ শক্তি বঞ্চিত হয়ে আমরা উঠে যাচ্ছি উপরের দিকে। কোন অজানায়। তার
পরে আর কিছুই মনে
নাই।
চেতনা
ফেরার পর দেখলাম গম্বুজের
আকৃতিতে তৈরী খাটের ওপরে
শুয়ে আছি। শরীরটা ব্যথায়
টনটন করছে। কোন রকমে উঠে
বিছানায় বসলাম মেয়েটিকে কোথাও দেখলাম না। জেলখানার বন্দীর
মতো মনে হচ্ছে নিজেকে।
ঘরের চারিদেকে একবার চোখ বুলালাম কোন
দরজা জানালা দেখতে পেলাম না। অদ্ভুত রঙের
আলোয় সারা ঘর আলোকিত।
ঘরে তেমন আসবাব পত্র
কিছুই নাই। মেঝেয় একটা
কার্পেট বিছানো।
পশ্চিম
পাশে পর্দাঘেরা একটা কুঠুরীর মতো
মনে হলো। পর্দাটা বেশ
ভারী এবং সুক্ষ কাজ
করা ভিতরে কি আছে একবার
দেখার ইচ্ছে হলো কিন্তু উঠতে
পারলাম না। সুন্দর একটা
ঘুম হয়েছে মাথাটা বেশ ঠান্ডাই মনে
হচেছ। পেটের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
ক্ষুধায় নাড়ী ভুড়ি হজম
হবার অবস্থা হয়েছে। আজ কি বার
কত তারিখ কিছুই বলতে পারবো না,
দিন রাত কোন দিক
দিয়ে কেটে যাচ্ছে জানি
না। শুধু মনে পড়ছে
৭ তারিখ বিকেলে আমি বাড়ী থেকে
বের হয়েছি এর মধ্যে আর
খাওয়া হয় নাই, এর
মধ্যে মেয়েটি আমাকে কিছু গমের দানা
আর ভুষি মত কি
যেনো খেতে দিয়েছিল। ছাগলের
খাদ্য অথচ খুব সুস্বাদু।
খাওয়ার সাথে সাথে ক্ষুধা
উধাও। এক অনাবিল শান্তিতে
ভরে উঠেছিল মন।
মেয়েটিকে
কোথাও দেখা যাচ্ছে না,
ওর কথাই ভাবছিলাম, হঠাৎ
ক্যাচ করে দক্ষিণের দেয়ালের
একাংশ ফাঁক হয়ে গেল।
প্রবেশ করলো মেয়েটি। এক
হাতে গোল বারকোষ। বেশ
কিছু ফল, আর সেই
ভুষি মতো ছাগলের খাবার।
খাবার
দেখে আমার আর হুস
বুদ্ধি নেই বারকোষটি টেনে
নিলাম সামনে। এখন ফেব্রুয়ারী
মাস অথচ দেখলাম ডাঁসা
পেয়ারা যা আমার সবচেয়ে
প্রিয় ফল, জুলাই আগস্টের ফল। আরো আছে
আম, জাম কিছু লিচু
আপেল আঙ্গুর সবই আছে, নতুন
কিছু ফলও দেখলাম জীবনেও
তা দেখিনি। খেতে যাবো তখন
মেয়েটি বললো কি ব্যাপার
হাত মুখ ধোবে না?
লজ্জা পেয়ে উঠে পড়লাম-বললাম তাইতো ধোবো কোথায়? তোমাদের
ঘরে তো কোন দরজা
বা হাত মুখ ধোওয়ার
জায়গা দেখি না।
মেয়েটি
আমার হাত ধরে টেনে
নিয়ে গেল উত্তর দিকের
দেয়ালের দিকে। দেয়ালের এক জায়গায় ছোট
একটা বাটনে চাপ দিতেই সরে
গেল দেয়াল। বেশ বড় অরেকটা
রুম। শাওয়ার, বাথ টাব, ট্যাপ
সব ঝকঝক করছে। মনে
হলো কেউ যেনো এই
মাত্র এর ফিনিশিং করেছে।
কিন্তু পানি নিতে গিয়ে
ট্যাপের কোন চাবি পেলাম
না মেয়েটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিট মিট কররে
হাসছে। এক মিনিট কেটে
গেল আমি নিরুপায়, মেয়েটিই
টেনে নিয়ে একটা শাওয়ারের
নীচে দাঁড় করালো সঙ্গে
সঙ্গে তীব্র বেগে পানি এসে
আমাকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিলো। গোসল করা ছাড়া
আর উপায় নাই। অনেক
দিন গোসল করি না,
গোসল করলে মনে হয়
ভালোই লাগবে। জামা কাপড় খুলে
ফেললাম পরণে শুধু জাঙ্গিয়া।
গোসল করতে খুব ভালো
লাগছিল। শরীরটা বেশ ঝর ঝরে
ও তাজা তাজা লাগলো
কিন্তু পড়বো কি? আবার
দরজা খুলে গেলো, তাড়া
তাড়ি শার্টটা দিয়ে লজ্জাস্থান ঢেকে
ফেললাম। মেয়েটা একটা টাওয়েল ও
কিছু পড়বার উপযোগী কাপড় আমার হাতে
দিয়ে বললো এগুলোই পড়ে
বেরিয়ে এসো কেমন?
মখমলের
তৈরী একটা হাফ প্যান্ট
ও একটা ওভার কোট
গায়ে বেরিয়ে এসে খেতে বসলাম।
ক্ষুধা আমার তুঙ্গে গোগ্রাসে
গিলতে শুরু করলাম সেই
ভুষি, দেখতে খারাপ লাগলেও খেতে অমৃত, ভিষণ
স্বাদ পেটটা ভরে খেয়ে নিলাম।
খাওয়া
শেষ হতেই আলস্য ভর
করলো শরীরে। সটান শুয়ে পরলাম
বিছানায়। মেয়েটা এটো থালা বাসন
নিয়ে একটা বেসিনের উপর
রাখতেই সে গুলো মুহুর্তে
উধাও হয়ে গেল, শুধু
বারকোষটা পরে থাকলো বেসিনে।
মেয়েটাও এসে শুয়ে পড়লো
আমার পাশে কোন সংকোচ
না করেই।
কিছুক্ষণ
বেশ নিরবেই কেটে গেল, কারো
মুখে কোন কথা নাই,
ওর শরীরের সাথে আমার শরীর
লেগে আছে, আমার সমস্ত
শরীর আনন্দের আবেশে ভরে গেছে। ওর
পড়নে একটা মখমলের হাতা
কাটা গেঞ্জি ও পায়জামা অদ্ভুত
সুন্দর লাগছে। কাঁচের শরীর থেকে মৃদু
হালকা আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে,
অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটির পাশে আমার মতো
সুঠাম সুন্দর যুবককেও খুবই বেমামান লাগছে।
আমাদের দেশের বিশ্ব সুন্দরীকেও এর
পাশে রাখলে তাকে অতিশয় কুৎসিৎ
লাগবে। নিঃসংকোচে আমার গায়ের সাথে
গা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটি। ২৪
বছরের একটা তরতাজা যুবকের
কাছে যদি একটা ১৮-১৯ বছরের অবিবাহিত
যুবতি মেয়ে এক সাথে
শুয়ে থাকে তখনকার অনুভুতিটা
কেমন হতে পারে পাঠক
একটু নিজেই কল্পনা করে নিন। এ
অনুভুতি আসলে বর্ণণা করা
যায় না।
আমার
আর ঘুম আসছিল না,
কিছুক্ষণ আগেই একচোট ঘুমিয়ে
নিয়েছি, মেয়েটির সাথে দেখা হওয়ার
পর থেকে এ পর্যন্তও
ওকে ভাল করে দেখার
সৌভাগ্য হয় নাই। কিছুক্ষণ
ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে
আদর করলাম, ওর ঠোঁটে একটু
চুমু দিলাম তার পর আরেকটা,
আরেকটা এভাবে অনেকগুলো চুমু খেলাম। ও
ঘুমিয়েই আছে মরার মতো
ঘুমুচ্ছে। আমি উঠে বসলাম
ওর একটা হাত নিয়ে
বুকের মধ্যে চেপে রেখেছি যাতে
ছুটে পালিয়ে না যায়, আমি
কি ওর প্রেমে পড়ে
গেলাম? ওর সুন্দর টোল
পড়া মুখখানার প্রতি শুধুই তাকিয়ে আছি। মুখ ফেরাতে
ইচ্ছে করছে না। রঙ্গিন
বাহারি প্রজাপতির মতো কি সুন্দরই
না দেখাচ্ছে ওকে, যতই দেখছি
ততোই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। এ
নেশা আগুণের প্রতি পতঙ্গের তীব্র আকর্ষণের মতো। সৃষ্টিকর্তা ওকে
এতো নিঁখুত ভাবে তৈরী করেছে
না দেখলে বোঝা যায় না।
আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান
শুণ্য হয়ে পড়েছি। ওকে
বিছানা থেকে টেনে তুলে
আদর করছি চুমু খাচ্ছি।
মেয়েটি হঠাৎ ঘুম থেকে
জেগে উঠলো ওর চোখ
মুখ লাল আগুণের মতো
হয়ে গেছে। সে আমাকে বুক
থেকে সরিয়ে দূরে ফেলে দিল।
অসম্ভব শক্তি মেয়েটির গায়ে। আমার গালে কষে
একটা থাপ্পড় মারলো আমি অজ্ঞান হয়ে
গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরলো
তখন দেখি আমি জোড়
পকুরের ঘাটের সিড়ির ওপরে। এখন আমি আমার
গ্রাম দেখতে পাচ্ছি, আমাদের বাড়ি দেখতে পাচ্ছি।
আমি বাড়ী গেলাম। মা
আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি
কান্না, আমি সে কান্নার
কোন কারণ খুঁজে পেলাম
না। শুধু দেখলাম মা
অনেকটা বুড়িয়ে গেছে। চুলে পাক ধরেছে।